Banner 1
Banner 2

সিলেট জেলার পটভূমি

মহান সাধক হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহপরাণ (র.)সহ ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেট একটি প্রাচীন জনপদ। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দের ভ্রমণ বিবরণী থেকে এ জেলা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। দশম শতাব্দীতে মহারাজা শ্রীচন্দ্র কর্তৃক উৎকীর্ণ পশ্চিমভাগ তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি এ জেলা জয় করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা সিলেট বা শ্রীহট্ট বহু আগে থেকেই একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৪ শতকে ইয়েমেনের সাধক পুরুষ হযরত শাহজালাল (র.) সিলেট জয় করেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তাছাড়া মুঘলদের সাথে যুদ্ধ, নানকার বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার অবদান অপরিসীম।
বিখ্যাত মুসলিম পরিব্রাজক আল-বিরম্ননী তাঁর ‘কিতাবুল হিন্দ’ নামক গ্রন্থে সিলেটকে সিলাহট নামে উল্লেখ করেন। বহু প্রাচীনকাল থেকেই এ জেলা শ্রীহট্ট নামে পরিচিত ছিল, হিন্দু পৌরাণিক অনুসারে ‘শ্রী’ অর্থ ‘প্রাচুর্য বা ‘সৌন্দর্য’ এবং হট্ট অর্থ ‘হাত’। যেখানে শ্রী এর হট্ট পাওয়া গিয়েছিল তাই শ্রীহস্থ, যা কালের বিবর্তনে শ্রীহট্ট নাম ধারণ করেছে। আরো একটি শ্রুতি, পাথরকে শীলা বলা হয় এবং পাথরের প্রাচুর্য্যের কারণে এ এলাকাকে সিলেট বলা হয়। সিলেট শব্দের অনুসর্গ সিল মানে শীল এবং উপসর্গ হেট মানে হাট অর্থাৎ বাজার। প্রাচীনকাল হতে এ জেলা পাথর (শীল) ও হাটের (ব্যবসা ও বানিজ্যের) প্রাধান্য ছিল বলে ‘শীল’ ও ‘হাট’ শব্দদ্বয় মিলে সিলেট শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
সিলেট জেলা ১৭৭২ সালের ১৭ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত এ জেলা ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঐ বছরই সিলেটকে নবসৃষ্ট আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দেশ ভাগের সময় ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে সিলেট জেলা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়। সিলেট জেলা তখন চট্টগ্রাম বিভাগের আওতাধীন ছিল। ১৯৮৩-৮৪ সালে বৃহত্তর সিলেট জেলাকে ৪টি নতুন জেলায় বিভক্ত করা হয় এবং ১৯৯৫ সালের ১ আগস্ট সিলেট বিভাগের সৃষ্টি হয়।
ঔপনিবেশিক আমল থেকেই সিলেট দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। ১৮৯৭ সালের ১২ জুনের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে পুরো শহর ধ্বংস হয়ে গেলেও পরবর্তীতে রেলওয়ে সংযোগসহ রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হয়। চা বাগানের বিস্তৃতি এবং ১৯৫০-৬০ দশক থেকে সিলেটের প্রবাসীদের অবদানে এ জেলার উন্নয়ন দ্রুত ঘটতে থাকে যা এখনো অব্যাহত আছে।
সুরমা-কুশিয়ারা নদীবেষ্টিত এ জেলায় রয়েছে অনেক হাওর-বিল, ছোট বড় টিলা কানন। রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকির অংশ বিশেষ। এ জেলা কৃষিফলন বিশেষত ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে এবং প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ। জেলার উত্তরপূর্ব কোণে রয়েছে খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের প্রামত্ম-পাদদেশ। এখানকার মাটি চা চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী এবং এর অপার সৌন্দর্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। সিলেটের জাফলং, লালাখাল, ভোলাগঞ্জ, জৈন্তাপুর, বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত চা বাগানসহ অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের উন্নতমানের রিসোর্ট ও পর্যটন স্পট হিসেবে বিবেচিত হয়।
এছাড়া সিলেট জেলা প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, চুনাপাথর, কঠিন শিলা, বালুসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে অনন্য একটি জেলা। খনিজ সম্পদ আহরণের পাশাপাশি পর্যটন ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করলে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে প্রচুর পরিমাণে রাজস্ব আয় করা সম্ভব হবে। শুধু রাজস্Title নয় পর্যটন শিল্পের বিকাশে ও যথাযথ উপভোগে দেশজ পর্যটকগণের মনেও প্রবাহিত করা যেতে পারে অফুরান সুখ শান্তি যা দেশ গঠনের সম্ভাবনাকে করতে পারে গতিময় ও বেগবান।

সিলেট জেলা: আয়তন ৩,৪৫২.০৭ বর্গ কি.মি বা ১৩৩২.০০ বর্গমাইল। উত্তরে ভারতের খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়, দক্ষিণে মৌলভীবাজার জেলা, পূর্বে ভারতের কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলা, পশ্চিমে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা। বার্ষিক গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩.২০ সে., সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৩.৬০ সে., বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাত ৩৩৩৪ মি.মি.। সিলেটের প্রধান ও দীর্ঘতম নদী সুরমা (৩৫০ কি.মি.), অপর বৃহৎ নদী হলো কুশিয়ারা। এ জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে মোট ৮২টি হাওর-বিল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সিংগুয়া বিল (১২.৬৫ বর্গ কি.মি.), চাতলা বিল (১১.৮৬ বর্গ কি.মি.) উল্লেখযোগ্য। সিলেটে সর্বমোট রিজার্ভ ফরেষ্ট ২৩৬.৪২ বর্গকি.মি.। জেলার উত্তর-পূর্ব কোণে ভারতের খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড়ের অংশ বিশেষ বিদ্যমান। সিলেটে বেশ কিছু ছোট ছোট পাহাড় ও টিলা রয়েছে, যার মধ্যে জৈন্তাপুর টিলা (৫৪ মিটার), শারি টিলা (৯২ মি.), লালাখাল টিলা (১৩৫ মি.), ঢাকা দক্ষিণের টিলা শ্রেণি (৭৭.৭ মি.) উল্লেখযোগ্য।
সিলেট (জেলা শহর) ২৭টি ওয়ার্ড ও ২১০টি মহল্লা নিয়ে গঠিত। আয়তন ১০.৪৯ বর্গ কি.মি.। জনসংখ্যা ২৮৫৩০৮; পুরুষ ৫৪.৬৮%, মহিলা ৪৫.৩২%। জনসংখ্যার ঘনবসতি প্রতি বর্গ কি.মি. ২৭২২৪ জন। শিক্ষার হার ৬৬.৯%। ঔপনিবেশিক আমলেই সিলেট দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে। সিলেট পৌরসভার সৃষ্টি ১৮৭৮ সালে। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন এক মারাত্মক ভূমিকম্প গোটা শহরটিকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে। পরবর্তীতে ধ্বংসস্তুপের ওপর গড়ে উঠে ইউরোপীয় ধাঁচের আরও সুন্দর ও আধুনিক শহর। ১৮৯০ এর দশকের শেষ ভাগে বেশ কিছু রাস্তাঘাট তৈরি করা হয়। ১৯১২-১৫ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের একটি শাখা সিলেটের সাথে সংযুক্ত হলে দেশের অন্যান্য অংশের সাথে সিলেটের বিচ্ছিন্নতার প্রকৃত অবসান ঘটে। চা শিল্পের কারণে বিশ শতকের প্রথম দিকে সিলেট শহরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫০ ও ১৯৬০ দশকে প্রবাসী সিলেটিদের এবং সিলেট শহর দ্রুত নগরায়ণ ঘটতে থাকে এবং বর্তমানে ও তা অব্যাহত রয়েছে।


প্রশাসন: ১৭৭২ সালের ১৭ মার্চ সিলেট জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত সিলেট জেলা ছিল ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভূক্ত। ঐ বছরেরই ১২ সেপ্টেম্বর নবসৃষ্ট আসাম প্রদেশের সাথে সিলেটকে সংযুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ এর আগ পর্যন্ত (১৯০৫-১৯১১ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ সময়ের কালটুকু বাদ দিয়ে) সিলেট আসামের অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় গণভোটের মাধ্যমে সিলেট জেলা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এর সাথে সম্পৃক্ত হয়। তখন প্রশাসনিকভাবে সিলেট ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভূক্ত। ১৯৮৩-৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠন এর সময় বৃহত্তর সিলেট জেলাকে ০৪ (চার) টি নতুন জেলায় বিভক্ত করা হয়। এই নতুন জেলাগুলো হলো : সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। ১৯৯৫ সালের ১ আগষ্ট সিলেট দেশের ষষ্ঠ বিভাগ হিসেবে মর্যাদা পায় এবং মূলত বৃহত্তর সিলেট জেলার সীমানাই নতুন সিলেট বিভাগের আওতাভূক্ত করা হয়। উপজেলা- ১৩, পৌরসভা-৪, ওয়ার্ড-৩৭, মহল্লা-২৩৩, ইউনিয়ন-১০৬, মৌজা-১৬৯৩, গ্রাম-৩২৪৯। উপজেলাসমূহ : বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ, গোয়াইনঘাট, বিয়ানীবাজার, কোম্পানীগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, ওসমানী নগর ও জকিগঞ্জ।


প্রাচীন নির্দশনাদি ও প্রত্নসম্পদ:জৈন্তাপুরের প্রসত্মর স্মৃতি, গড়দুয়ার ঢিবি, গায়েবী মসজিদ, হযরত শাহজালাল (র.) ও শাহ্পরাণের (র.) দরগাহ্, আবু তোরাব মসজিদ, নবাবী মসজিদ, আখালিয়ার মুঘল মসজিদ, ঢাকাদক্ষিণ মন্দির, তিন মন্দির।


ঐতিহাসিক ঘটনাবলী: সিলেট একটি প্রাচীন জনপদ। সুলতানী আমলে সিলেটের নাম ছিল জালালাবাদ। দশম শতাব্দীতে মহারাজা শ্রীচন্দ্র কর্তৃক উৎকীর্ণ পশ্চিমবাগ তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি সিলেট জয় করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা, সিলেট বা শ্রীহট্ট (সমৃদ্ধ হাট) বহু আগে থেকেই একটি বর্ধিষ্ণু বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে বর্তমান ছিল। প্রাচীন শ্রীহট্টে বিপুল হারে বাঙালি অভিবাসন হয়েছিল। ১৪ শতকে ইয়েমেনের সাধক পুরুষ হযরত শাহজালাল (র.) সিলেট জয় করেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন। মোগল যুগে পাঠান বীর খাজা ওসমান সিলেটের স্থানীয় সামন্তদের সহায়তায় আক্রমণকারী মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহের সময়ে সিলেটে বিদ্রোহীরা বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ব্যর্থ হয়। নানকার বিদ্রোহ সিলেটের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নানকাররা ছিল জমিদারদের ভূমিদাস। নানাকার বিদ্রোহ সহ আরও কয়েকটি বিদ্রোহ সংঘটিত হলে ১৯৫০ সালে এ প্রথা বিলুপ্ত করা হয়।
সিলেট যখন আসামের অংশ ছিল সেই সময়েই, ১৯২৭ সালে সিলেটের রাজনীতিবিদগণ (এম.এল.এ গণ) প্রাদেশিক পরিষদে বাংলায় কথা বলার অধিকার আদায় করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৭ সালে সিলেটের স্থানীয় পত্রিকা আল ইসলাহতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়।